কানাডায় ভিসার জন্য কাগজ প্রসেসিং দুইভাবে করা যায়। ১. সরাসরি সব
ডকুমেন্টস হাইকমিশনে জমা দিয়ে, অথবা ২. ভিএফএস বলতে হাইকমিশনের মনোনীত
প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জমা দিয়ে। আমি ভিএফএস এর খেকে করেছিলাম, ভিএফএস আসলে
কুরিয়ার এর কাজ করে, সব ডকুমেন্টস অ্যাপ্লিক্যান্ট এর থেকে নিয়ে হাইকমিশনে
জমা দেয়।
ভিসা প্রসেসিং এর জন্য প্রথমেই সিটিজেনশিপ এন্ড ইমিগ্রেশন কানাডার
ওয়েবসাইট ভালমত দেখে কিছুক্ষন উদাস হয়ে বসে খাকতে হবে। বিশেষ করে
Instruction Guide (IMM 5269) পড়ে নিয়ম গুলো ভাল করে দেখার পরামর্শ রইল।
প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র:
দরকারী ফরম আর কাগজপত্রের চেকলিস্ট ভিএফএস এর
সাইট বা হাইকমিশনের
সাইট
-এ পাওয়া যাবে। সব গুলো ফরম ডাউনলোডের পরে ওপেন করে দুইহাত দিয়ে ভালমতো
মাথা চুলকে নিতে হবে। এর পরে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস সংগ্রহের অভিযানে নামতে
হবে।
স্টাডি পারমিট চেকলিস্ট -এই কি কি লাগবে মূলত: বলা আছে, তবু্ও আমি আর একটু খই ভাজি।
সাপোর্টিং ডকুমেন্টস হিবেবে ইউনিভার্সিটির ভর্তির অফার লেটার,
টিএ/আরএশিপ এর অরিজিনাল কপি লাগবে। স্ক্যান কপি দিয়েও অ্যাপ্লাই করা যায়,
তবে প্রসেসিং শুরুর সময় তারা মূল কপি চাইবেই। কারো অফার লেটার যদি
কন্ডিশনাল হয়, সেইক্ষেত্রে কিভাবে কন্ডিশন স্যাটিসফাই করা হবে সেই
সন্ক্রান্ত কাগজ ও দিতে হবে। আমি আন্ডারগ্র্যাড এর ৭টার্মের রেজাল্ট দিয়ে
ইউনির্ভাসিটিতে অ্যাপ্লাই করেছিলাম। আমার অ্যাডমিশন অফার লেটার-এ বলা ছিল
বিএসসি সার্টিফিকেট দেখাতে হবে। আমি বিএসসি সাটিফিকেট এখন পর্যন্ত দিতে
পারিনি, আমার প্রসেসিং পেন্ডিং আছে। এছাড়া আন্ডারগ্র্যাডুয়েট/মাস্টার্স,
এইচএসসি, এসএসসির সাটিফিকেট ও মার্কশীট, আইইএলটিস/টোফেল এর রেজাল্ট লাগবে।
সকল ডকুমেন্টস এর মূল কপি ও এক কপি ফটোকপি দিতে হবে, আমি ফটোকপি সার্টিফাইড
করে দিয়েছিলাম, সেই প্রসংগে পরে আসছি। পাসপোর্টের ফটোকপি ২-১ কপি বেশি
নিয়ে যাওয়া ভাল।
এর পরে যারা স্পন্সর থাকবে (বাবা-মা বা নিকট আত্নীয়) তাদের আয়কর সনদ,
ব্যাংক স্টেটমেন্ট যাতে কমপক্ষে ছয়মাসের ট্রানসাকাশন থাকতে হবে,
এফডিআর/সঞ্চয়পত্র এই সবের স্টেটমেন্ট লাগবে। আমার কাছে ভিএফএস থেকে
স্পনসরদের চাকুরীর অ্যাপয়েন্ট লেটারও চেয়েছিল, আমি দিতে পারিনি। এটা তেমন
বাধ্যতামূলক না, তবে সাথে থাকলে দেয়া যেতে পারে। যদি স্পন্সর রক্তের
সম্পর্কযুক্ত না হয় তবে কেন উনি স্পনর হতে চান এই বিষয়ে বলতে হবে। আমার
ক্ষেত্রে আমার বাবা-মা স্পন্সর ছিলেন, তাই এই বিষয়ে কি কি কাগজ দিতে হবে
আমি ঠিক নিশ্চিত না।
বার্থ সাটিফিকেট ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট লাগবে। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট পাবার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ডিএমপির
সাইটের এই
পিডিএফ
এ পাওয়া যাবে। ক্লিয়ারেন্স এর জন্য ৫০০/- টাকার ট্রেজারী চালান করতে হয়।
এইটা আবার সোনালী ব্যাংক এর সব শাখায় করা যায় না। বুয়েটের নিকটবর্তী এলাকার
মাঝে নিউমার্কেট ও হাইকোর্ট শাখায় করে। অন্য আর কোথায় করে নিশ্চিত না, তবে
যেকোন শাখা থেকে শুনে নেয়া যাবে। ট্রেজারী চালান এর ফরম পূরন এর সময় কোড
নম্বর (1-2201-0001-2681) এ কাটাকুটি বা ভুল হবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত
থাকতে হবে। মুড়ি খেতে না চাইলে ক্লিয়ারেন্স এর জন্য আবেদন জমা দিতে বিকাল
৪টার পূর্বেই যেতে হবে।
কানাডায় স্টাডি পারমিট এর জন্য কমপক্ষে ১০,০০০ কানাডিয়ান ডলার এর
সমতুল্য টাকা/সম্পদ দেখাতে হয়। তবে কোন আপার লিমিট নাই। রুল অব বৃদ্ধাঙ্গুল
হিসেবে যত বেশি যত লিকুইড মানি+প্রপারটি দেখানো যায় ততই ভাল। টাকা বা
সম্পত্তি (যেমন বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট, টাকা ইত্যাদি) যাই দেখানো দরকার
নোটারাইজড করে দিতে হবে। আমি গুলশান-২ গোলচক্কর এর কাছে জাহিদ প্লাজার ২য়
তলায় অ্যাডভোকেট মনজুর কাদির এর থেকে করেছিলাম। ওখানে গিয়ে কানাডার স্টাডি
পারমিটের জন্য নোটারী করতে চাই বললেই ওরা ১টা এভিডেভিড করে দিবে। এভিডেভিড
করার জন্য আমি সব ডকুমেন্টস এর মূল কপি নিয়ে গিয়েছিলাম, যদিও অ্যাডভোকেট
কিছুই দেখেননি। তবে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সাথে নিয়ে যাওয়া ভাল। আমি
অবশ্য প্রতিটি ডকুমেন্টস (অফার লেটার, পুলিস ক্লিয়ারেন্স, বার্থ সাটিফিকেট,
ব্যান্ক স্টেটমেন্ট সহ আর যা যা জমা দিতে হবে) এর ফটোকপি নোটারীর অফিস
থেকে সার্টিফাইড করে নিয়েছিলাম। সার্টিফাই করে নিলে ওরা ১টা লাল খাঁজকাটা
সিল মেরে দিবে। ফটোকপির সার্টিফাইড কপি জমা দেয়া বাধ্যতামূলক না, আমি
দিয়েছিলাম। প্রতি কপি সার্টিফাই করতে ২০/- করে নিয়েছিল। সব মিলিয়ে নোটারীর
অফিসে ১৫০০-/ বা ২০০০/- টাকা বিল এসেছিল, সঠিকটা মনে নাই। নোটারীর অফিস
সকাল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
ছবি:
ভিসার জন্য ছবি জমা দেবার ক্ষেত্রে কিছু
নিয়মকানুন
আছে। সোজা উপায়ে পয়সা খরচ করতে না চাইলে ঘরের দেয়ালের সামনে দাড়িয়ে ছোট
ভাইবোনকে দিয়ে ছবি তুলে নেয়া যেতে পারে। পরে স্কেল দিয়ে খোমা মেপে গিম্পে
এডিট করে নিলেই হবে। অল্টারনেট অপশন হিসেবে গুলশান-২ তে ভিআইপি স্টুডিও
(Gulshan Palladium (1st floor), রোড ৯৫, গুলশান-২) থেকেও তোলা যায়।
এইক্ষেত্রেও দেশের নাম বলে দিলে ওরা ঐ মাপে ছবি তুলে দেয়। আমি অবশ্য ছবি
তোলার জন্যই জীবনে প্রথমবারের মত টাই পরেছিলাম। নোটারীর অফিস আর স্টুডিও
হন্টন দুরত্ব। একাধিক বার যেতে না চাইলে একই দিনে নোটারী আর ছবি তোলার
ঝামেলা শেষ করে ফেলাই উত্তম।
ফরম পূরণ:
অ্যাপ্লিকেশন ফরম (IMM1294E)
পূরণ করার জন্য অ্যাডোবি অ্যাক্রোব্যাট রিড়ার লাগবে। আমার কাছে
অ্যাক্রোব্যাট এর ফ্রি ভার্সণ ছিল, ওইটা দিয়ে পিডিএফ এর উপর লিখতে পারিনি।
বাকি ফরম যেমন ফ্যামিলি ইনফরমেশন, স্টুডেন্ট ক্যোশ্চিনিয়ার এইসব আমি ফক্সইট
দিয়ে পূরণ করেছিলাম।
স্টুডেন্ট ক্যোশ্চিনিয়ার এর ২ ও ৫ পূরণ এ সতর্ক থাকতে হবে। “Why have
you chosen to study abroad? How does this course differ from similar
courses available in Bangladesh?” এর উত্তরে বলা যেতে পারে X
ইউনিভার্সিটির Y কোর্সটা বাংলাদেশের ভবিষ্যত উন্নতির জন্য ইতিবাচক, এর ফলে
এদেশের জনগোষ্টীর একটা বিশাল অংশ P Q R উপকার সমূহ পাবে। এছাড়া আরও কয়েকটি
টিপস:
১. ফরম গুলো একটু সময় নিয়ে কয়েকদিন ধরে পূরণ করলে ভাল।
২. ফরমের প্রিন্টআউড নিতে লেজার প্রিন্টার রিকমেন্ড করা হয়। লেজার প্রিন্ট এর সুবিধা থাকলে তা দিয়ে করাই শ্রেয়।
৩. পুরো প্রসিডিওর সমাপ্ত করতে গিয়ে জীবনের প্রতি বৈরাগ্য আসতেই পারে, এটা স্বাভাবিক।
৪. সম্ভব হলে অন্যান্য ডকুমেন্টস আগে থেকেই রেডি করে রেখে অফার লেটার
পাবার পর সময় নষ্ট না করে স্টাডি পারমিটের জন্য আবেদন করে ফেলা ভাল।
ডকুমেন্টস জমা:
সকল ফরম প্রিন্ট করে জমা দেবার আগের দিন ই রিভিউ করে রাখা উত্তম। আমার
সব কিছুই ১১তম ঘন্টায় হয়, কাজেই যারা আমার মত তারা জমা দেবার দিন সকালে
তাড়হুড়ো করে প্রিন্ট করতে পারো। ডকুমেন্টস জমা দেবার আগের দিন রাতে ভিসা
রিফিউসাল এর মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকতে আর্টফিলম দেখা যেতে পারে।
ডকুমেন্টস জমা দেবার দিন সকাল সকাল ই মিশন ভিএফএস এ রওনা দেয়া উচিত। কোন
কারন নাই, তবু্ও আমি রিকমেন্ড করব ফরমাল ড্রেসআপ এ যেতে। ভিএসএর সাইটে
লোকেশন পরিস্কার করেই দেয়া আছে। কিন্তু আমি গুলশানের দিক একটু কম চিনি দেখে
খুঁজে পেতে একটু সমস্যা হয়েছিল। কেউ যদি মহাখালী-তিতুমীর কলেজের-ব্র্যাক
উইনির সামনে দিয়ে যায় তাহলে গুলশান ১ এর গোলচক্কর থেকে হাতের ডানে যেতে
হবে। কিছুদুর গেলেই অ্যাবাকাস চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ছাড়িয়ে সামনে গেলে হাতের
উল্টো পাশে সিমেনস এর সাদা বিল্ডিং দেখা যাবে। তার পাশেই ভিএফএস এর অফিস।
ভিএফএস এর অফিস এ কি কি অ্যালাউড না তা তা
এখানে
বলা আছে। অফিসের মধ্যে অ্যাপ্লিক্যান্ট ছাড়া অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া
হয় না। এছাড়া কোন ব্যাগ থাকলেও প্রবেশ এর সময় জমা রাখে। তাই বড় দেখে
প্লাস্টিকের ট্রান্সপারেন্ট ফাইলে করে সব ডকুমেন্টস নিয়ে যাওয়া ভাল। অফিসে
ঢোকার আগে নিচে সিকিউরিটির থেকে ১টা স্লিপ নিয়ে উপরে উঠতে হবে। উপরে উঠে
সিকিউরিটি চেকিং শেষে ডকুমেন্টস জমা নেবার রুম এ বসতে হবে। এসসময় সাময়িক
উত্তেজনা ও দুশ্চিন্তার কারনে মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব হতে পারে। কাউন্টার
থেকে ডাক পরলে সকল ডকুমেন্টস নিয়ে যেতে হবে। সেখান থেকে ওরা পাসপোর্ট সহ
১টা ১টা করে বিভিন্ন ডকুমেন্টস বুঝে নিবে। সাথে দুইটা ফরম পূরন করতে বলবে।
আমি যেই বুথে সব কিছু জমা দিয়েছিলাম সেখানে গভ: ল্যাব এর এক ভাইয়া ছিলেন।
ভিসা ফরমে আমার স্কুল ল্যাব দেখে স্কুল বিষযে টুকটাক প্রশ্ন করেছিলেন।
ল্যাব রকস!
সব ডকুমেন্টস জমা নেয়া শেষে পাশে ভিসা ফি ব্যাংক ড্রাফট করতে পাঠাবে। ব্যাংক ড্রাফটের জন্য
সঠিক অ্যামাউন্টের
খুচরা (৯৫০০+৮৭৫+২৩০) সাথে রাখা দরকার। সব শেষে ট্র্যকিং নাম্বার সহ ১টা
রিসিট দেয়া হবে। রিসিট সযত্নে না রাখলে ঝামেলাহীনভাবে মুড়ির সংস্থান হয়ে
যাবে। ভিএফএস এর অফিস খেকে বের হয়ে লম্বা ১টা শ্বাস নিয়ে বাসার দিকে হন্ঠন
করা যেতে পারে।
পরবর্তী ধাপ:
বিধি লেফট হ্যান্ডেড না থাকলে ১০ কর্মদিবসের মাঝে ভিএফএস থেকে ফোন পাবার
কথা। আমার ক্ষেত্রে ২/৩ দিনের মাঝেই ফোন পেয়েছিলাম। যদি সব ঠিক খাকে
মেডিক্যাল টেস্টের জন্য পাসপোর্ট ফেরত দিবে। অ্যাপ্লিকেশন এর সমং যেসকল মূল
কপি জমা দেয়া হয়েছিল সেগুলোও ফেরত দিয়ে দিবে। পরে ওদের রিকমন্ডেড
মেডিক্যাল সেন্টার গুলোর যেকোনটা থেকে মেডিক্যাল টেস্ট করতে হবে। আমি
বারিধারায় ওয়াহাব মেডিক্যাল সেন্টার থেকে করেছিলাম। ঠিকানা ভিএফএস থেকেই
দেয়া ১টা কাগজে লেখা থাকবে। গেলেই ওরা ১টার পরে ১টা টেস্ট করতে থাকে, সাথে
কয়েকটা ফরম পূরন করতে হয়। কি কি টেস্ট করতে হবে তার ১টা ধারনা
এখান
থেকে পাওয়া যাবে, আমি আর লিখলাম না। মেডিক্যাল টেস্টের সময় পাসপোর্ট এবং ২
কপি ছবি নিয়ে যেতে হবে। মেডিক্যাল টেস্টে সম্ভবত ৩০০০/- টাকা লাগে।
টেস্টের রিপোর্টে কোন সমস্যা থাকলে মেডিক্যাল সেন্টার খেকেই ফোনে বলে দিবে।
টেস্ট শেষে পাসপোর্ট আর ভিএফএস এর রিসিট নিয়ে আবার ভিএফএস এ যেতে হবে।
এইবার অবশ্য নিচে সিকিউরিটির থেকে স্লিপ নেয়া লাগবে না। সবকিছু ঠিক ঠাক
থাকলে ২/৩ সপ্তাহ পরে স্টাডি পারমিট পেয়ে যাবার কথা। আমি যেহেতু এখনও আমার
আন্ডারগ্র্যাডুয়েট এর সার্টিফিকেট জমা দিতে পারিনি, আমার প্রসেসিং এখনও
পেন্ডিং আছে। তাই সঠিক কয়দিন লাগে বলতে পারছিনা।
আপাতত: আর কিছু মনে পড়ছেনা, কিছু বাদ গেলে পরে লিখে দিব। হ্যাপি ভিসা প্রসেসিং ।